নাটোর উত্তরা গণভবন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
নাটোর উত্তরা গণভবন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী
পোস্ট সূচিপত্র ,
- ভূমিকা
- যোগাযোগ ব্যবস্থা
- নামকরণ
- নাটোরে উত্তরা গণভবন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ।
- উপসংহার ।
ভূমিকা
যোগাযোগ ব্যবস্থা
নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাস এক বিখ্যাত দিঘাপতিয়ারাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতিচারণ প্রতীক ।নাটোর শহরের যে কোন স্থান থেকে সরাসরি রিক্সা বা অটোরিক্সা যোগে যাওয়া যায়। শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে উত্তরা গণভবনের রিকশা ভাড়া ৩০ টাকা।যাতায়াতের জন্য রিক্সা বা অটোরিক্সা রিজার্ভ না নেয়াই ভাল। কেননা নাটোর শহরের সকল স্থানেই স্থানীয় যানবাহন পর্যাপ্ত চলাচল করে।১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গনভবন ঘোষণা করেন।
নামকরণ
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণা-বেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে দিঘাপতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের ২৪শে জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আব্দুল মোনায়েম খাঁন দিঘাপতিয়ার গভর্ণরের বাসভবন (The East Pakistan Governor's house of Dighapatia) হিসেবে উদ্বোধন করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গনভবন ঘোষণা করেন।
প্রাসাদের পিছন দিকে রয়েছে ফোয়ারা সহ একটি সুদৃশ্য বাগান। বাগানের এক কোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরি একটি নারী মূর্তি। ১৯৪৭ সালের পর অবশ্য এ ভবনে আর কেউ বসবাস করেন নি।
আরো পড়ুন,চলন বিল নিয়ে কিছু অজানা কথা
নাটোর উত্তরা গণভবন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা :
নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাস এক বিখ্যাত দিঘাপতিয়ারাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। নাটোরের রাণী ভবানী তাঁর নায়েব দয়ারামেরউপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীনপাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান।পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজ প্রাসাদটি পরিত্যাক্ত থাকে।
১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সরকারি ভবন হিসেবে সংস্কার হয়। ১৯৭২ সালে উত্তরা গণভবন হিসেবে অভিহিত করা হয়। চারিদিকে মনোরম পরিবেশে, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট বড় কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে নাটোর উত্তরা গণভবন ৪১.৫১ একর জমির উপর অবস্থিত। অভ্যন্তরে রয়েছে ইতালী থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির নানা উদ্ভিদ।
রাজা প্রমদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশী মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির উপর এই রাজবাড়ীটি পুনঃ নির্মাণ করেন।
সাড়ে ৪১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি উচু প্রাচীর ঘেরা। প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার রয়েছে যা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে এবং এর উপরে একটি ঘড়িও রয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতোই নাটোরের রাজবাড়ীতে রয়েছে দীর্ঘ প্রবেশ পথ । নাটোরের ঐতিহাসিক দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ী বর্তমানে উত্তরা গণভবন। প্রায় তিনশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি নাটোরের উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা-মহারাজ রামজীবনের একান্ত অনুগত একজন দেওয়ান ছিলেন। নাটোর রাজ্যের উত্থানে দয়ারাম রায় অসামান্য ভূমিকা রাখায় ১৭০৬ সালের দিকে রাজা রামজীবন উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য তাকে দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন। পরবর্তীতে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তরা গণভবনের প্রবেশ পথের বিশাল ফটকটি আসলে একটি বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি। ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন। ঘড়িটির পাশে রয়েছে একটি বড় ঘণ্টা। এক সময় এই ঘণ্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেতো।
প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ বাগান একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান পরিলক্ষিত হয়। কামানগুলোর স্থাপনকাল ছিল ১৭৯৯ সাল। বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতিচারণ প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ রযেছে আরো দুইটি ভবন।
ইতালীয় গার্ডেন উত্তরা গণভবনের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম ইটালি থেকে আনিয়েছিলেন। ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি উপভোগ্য। বেঞ্জগুলো কোলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। পাহাড়িকন্যা পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙা। হাতের কবজিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল। এখানে রাণীর টি হাউসটি অতুলনীয়।
উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে।
প্রতিটি পুকুর পরিখায় সানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গিয়েছে। ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় দেশ ত্যাগ কের চলে যান। এসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়ীটি অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন গভর্নর হাউসে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই ভবনের মূল প্রাসাদের ভিতর মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন। সেই থেকে ভবনটি ‘উত্তরা গণভবনের' প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।
প্রাসাদের ভিতর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমাবেশ ও সমারোহ। ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখানকারই। এছাড়া অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পরিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ প্রাচীন এই অবকাঠামোকে ঘিরে অজস্র আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, পাম ও চন্দনাসহ দুর্লভ জাতের গাছ লাগানো ছিল। অযত্ন আর অবহেলায় ইতোমধ্যে অনেক গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে নাটোর দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬৮০ সালে নাটোরের কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকুরী করতেন, সে সময়ে তিনি কাজ উপলক্ষ্যে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌছেন। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে সাধারণ একজন কর্মচারী তখন দয়ারাম তাঁর মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরী করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মহুরী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি, নবাব সরকারের ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের নজরে সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন তখন তারও ভাগ্য খুলতে থাকে। তিনি প্রথমে রাজা রামজীনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম এর সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘‘রাই রাইয়া’’ খেতাবে ভুষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি মূল্যবান সম্পদসমূহ লুন্ঠন করেন। কিন্তু সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পন করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কার স্বরূপ নাটোর দিঘাপতিয়ায় একখন্ড জমি দান করেন এবং বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনা দান করেন। এটাই নাটোর দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়া তরফ নন্দকুজা, যশোহরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এইভাবে নাটোর দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালে।
উপসংহার
প্রায় তিনশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি নাটোরের উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন বর্তমানে এটি দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অণুমতি সাপেক্ষে উন্মুক্ত রয়েছে।সকাল ৯:০০টা থেকে বিকাল ৫:০০টা পর্যন্ত ২০ টাকা মুল্যের টিকেট ক্রয় করে গণভবনে প্রবেশ করা যায়।
Comments
Post a Comment